Skip to main content

LAND REFORMS- BENGALI

 

ভূমি সংস্কার


ভূমি সংস্কার সরকার কর্তৃক ভূমির উৎপাদন সম্পর্কিত সামগ্রিক ব্যবস্থার পরিবর্তন সূচিত করে এমন ব্যবস্থা। ভূমি সংস্কার বিষয়ে একটি বড় ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় ১৯৪০ সালে, বেঙ্গল ল্যান্ড রিফর্মস কমিশন নামে একটি কমিটি গঠনের মাধ্যমে। এর চেয়ারম্যান ছিলেন স্যার ফ্রান্সিস ফ্লাউড। কমিশনটিতে বড় বড় জমিদারদের (ভূস্বামী) প্রতিনিধিও অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। ফ্লাউড কমিশন জমিদারি প্রথা বিলোপসাধন করার সুপারিশ করেছিল, ভূমিচাষিদের ওপরে রাজস্ব-আদায়কারী স্তর-উপস্তর ছিল, স্বভাবত তাদেরও অস্তিত্ব বিলোপের সুপারিশ ছিল। এর উদ্দেশ্য ছিল, জমিদারদের ইচ্ছাতে নতুন নতুন মধ্যস্বত্ব সৃষ্টি করার যে প্রথা ছিল (যার ফলে অসংখ্য মধ্যস্বত্বের উদ্ভব হয়েছিল ও যাদের একমাত্র ভূমিকা ছিল নিম্ন স্বত্বাধিকারীদের নিকট থেকে খাজনা আদায় করা) তার অবসান ঘটানো। কমিশন শীর্ষে অবস্থিত সরকার এবং নিম্নে কৃষক শ্রেণি এ দুয়ের মধ্যবর্তী সমস্ত মধ্যস্বত্বের বিলুপ্তি ঘটাতে চেয়েছিল। এছাড়া ভবিষ্যতে নতুন মধ্যস্বত্ব সৃষ্টির অধিকারও কেড়ে নেওয়ার বিধান সুপারিশ করা হয়। কিন্তু কমিশনের সুপারিশের আওতায় সেসব বর্গাচাষি বিবেচ্য হয়নি যারা শ্রমের বিনিময়ে জমির ফসলের একটি অংশ ভোগ করত। কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী যথাযথ আইনের খসড়া তৈরি হলেও সরকার ফ্লাউড কমিশন রিপোর্ট বাস্তবায়ন করে নি। ইস্ট বেঙ্গল স্টেট অ্যাকুইজিশন অ্যান্ড টেনান্সি অ্যাক্ট, ১৯৫০-এর মাধ্যমে ভূমি সংস্কারের ক্ষেত্রে প্রথম বড় পদক্ষেপ নেওয়া হয়।

এই আইনের বিধি অনুযায়ী প্রচলিত ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থার আওতায় ভূস্বামী, রায়ত বা কোর্ফা রায়তের উপরের খাজনা আদায়কারী ও মধ্যস্বত্বাধিকারী এবং রায়ত বা কোর্ফা রায়তের অবস্থান ও অধিকারের ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। ভূমির মালিক হিসেবে কোন ব্যক্তি তার দখলে সর্বোচ্চ কত পরিমাণ জমি রাখতে পারবেন ফ্লাউড কমিশন সে সম্পর্কে কোন সুপারিশ করেন নি। ইস্ট বেঙ্গল স্টেট অ্যাকুইজিশন অ্যান্ড টেন্যান্সি অ্যাক্ট-এর বিশেষ ধারা ও বিধি অনুযায়ী কোন ভূস্বামী বা ভূমির মালিক, জমিদার, মধ্যস্বত্বাধিকারী বা রায়ত তার দখলে একশত বিঘার বেশি জমি রাখতে পারবেন না।

ইস্ট বেঙ্গল স্টেট অ্যাকুইজিশন আইন বাস্তবায়ন করা ছিল একটি দীর্ঘসূত্রী ব্যবস্থা। আইনটি পাশ হওয়ার পর, এর দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে উল্লিখিত বিধি অনুযায়ী সরাসরি ভূমি অধিগ্রহণের ব্যবস্থা শুরু করা হয়। এই ব্যবস্থানুযায়ী বড় বড় জমিদারির মালিকদের খাজনা আদায় স্বত্ব আদায়ের কাগজপত্রের ওপর ভিত্তি করে সরকারি কাচারির আওতায় আনা হলো। একই পদ্ধতিতে ‘কোর্ট অব ওয়ার্ডস’ দ্বারা পরিচালিত জমিদারিগুলিও ফেরত নেওয়া হলো। এই জমিদারিগুলি সরকারি আওতায় কোর্ট অব ওয়ার্ডস আইন ১৮৭৯ অনুযায়ী পরিচালিত হতো। এই প্রক্রিয়ায় মোট ৪৪৩টি জমিদারি যার সর্বমোট বার্ষিক আয় ছিল চার কোটি চুয়াত্তর লক্ষ সাতাশ হাজার দুইশত সাত টাকা, সরাসরি অধিগ্রহণ করা হলো। কিন্তু এসব জমিদারির অধীনে যেসব মধ্যস্বত্বাধিকারী বা খাজনা-আদায়ি স্বত্ব ছিল সেগুলি কোনরকম হস্তক্ষেপ ছাড়া আগের অবস্থানেই রয়ে যায়।

স্টেট অ্যাকুইজিশন আইনে জমিদারি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে প্রথম বাধা আসে, যখন কোন কোন জমিদার উক্ত আইনের আওতায় তাদের জমিদারিস্বত্ব অ্যাকোয়ার করার বিরুদ্ধে স্থানীয় সাবজজ কোর্টে সিভিল স্যুট দাখিল করেন। তবে এ সকল সিভিল স্যুটের সবগুলিতেই নিম্ন আদালত এবং হাইকোর্ট উভয় জায়গাতেই সরকারের পক্ষে রায় ঘোষিত হয়।

১৯৫২ সালে সরকার সিদ্ধান্ত নিলেন যে, বাকেরগঞ্জ জেলায় (বর্তমানে বরিশাল) এবং খুলনার সুন্দরবন এলাকায়, যেখানে রেকর্ড অব রাইটস এবং মাপ অল্পদিন পূর্বেই আদালত কর্তৃক সংশোধন করা হয়েছিল, স্টেট অ্যাকুইজিশন আইনের পঞ্চম পরিচ্ছেদ অনুযায়ী সমগ্র খাজনা-আদায়ি স্বত্ব অ্যাকোয়ার করা হবে। এজন্য আইনত প্রাপ্য ক্ষতিপূরণ অ্যাসেসমেন্ট রোল তৈরি সম্পন্ন করার প্রয়োজন ছিল। নিয়মিত স্টেট অ্যাকুইজিশন অপারেশন সর্বপ্রথম শুরু হয় এই এলাকাতেই। আইন অনুসারে, পটুয়াখালী জেলাতে ১৪ এপ্রিল ১৯৫৪, তারিখ থেকে খাসজমি ছাড়া সকল খাজনা-আদায়ি স্বত্ব অ্যাকোয়ার করা হয়। একইভাবে, পিরোজপুর এবং বাকেরগঞ্জ জেলার বৃহত্তর অংশে ১৪ই এপ্রিল ১৯৫৬ তারিখে সমস্ত খাজনা-আদায়ি স্বত্ব (খাসজমি ছাড়া) অ্যাকোয়ার করা হয়।

১২ অক্টোবর ১৯৫৫ তারিখে, সরকার ঢালাওভাবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলেন যে দেশের অবশিষ্ট জেলাগুলিতে ১৫ এপ্রিল ১৯৫৬ তারিখ থেকে স্টেট অ্যাকুইজিশন আইনের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে বর্ণিত বিধি অনুযায়ী সমস্ত খাজনা-আদায়ি স্বত্ব সরাসরি অ্যাকোয়ার করা হবে। এটা অবশ্যই একটি বড় মাপের সিদ্ধান্ত ছিল এবং সরকার অর্ডার জারি করলেন যে অবিলম্বে প্রিলিমিনারি রেন্ট রোল তৈরি করতে হবে। এর জন্য সেই সময়ে রেকর্ড অব রাইটস যে অবস্থায় ছিল তা সরাসরিভাবে যতদূর সম্ভব সংশোধন বা আপডেট করে এবং সকল স্তরের খাজনা আদায়ের কাগজপত্র দেখে ঢালাও অ্যাকুইজিশনের তারিখের অব্যবহিত পূর্বের অবস্থা প্রতিফলিত করে ছয় মাসের মধ্যে এমন একটি রেন্ট-রোল তৈরি করতে হবে, যাতে সরকারি প্রশাসনযন্ত্র সর্বনিম্ন স্তরে খাজনা প্রদানকারীদের নিকট থেকে খাজনা আদায়ে সক্ষম হয়। সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশব্যাপী ১৪ এপ্রিল ১৯৫৬-এর পূর্বাবস্থার ওপর ভিত্তি করে মোটামুটি একটা নির্ভরযোগ্য সর্বনিম্ন স্তরের প্রদেয় খাজনার তালিকা তৈরি করা হয়। বিভিন্ন জোন-এ নিযুক্ত সেটেলমেন্ট অফিসারদের জন্য এটি একটি কঠিন কাজ ছিল; তবুও তারা কাজটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই সম্পন্ন করে এবং সমগ্র প্রদেশের জন্য কার্যকরী প্রাথমিক খাজনা আদায় তালিকা প্রণয়নে সক্ষম হয়। এই কার্যক্রম স্টেট অ্যাকুইজিশন সেটেলমেন্ট অপারেশন (এস.এস অপারেশন) নামে অভিহিত হয়।

সরকারের অবশ্যই বাধ্যবাধকতা ছিল সমস্ত খাজনা-আদায়ি স্বত্ব এবং অতিরিক্ত খাসজমি অধিগ্রহণের জন্য ক্ষতিপূরণ প্রদানের। তাই সেটেলমেন্ট অফিসারদের ওপর অতিরিক্ত দায়িত্ব বর্তালো, উপস্থিত ভিলেজ ম্যাপগুলি যথাসম্ভব অপরিবর্তিত রেখে রেকর্ড সংশোধনপূর্বক ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ তালিকা প্রস্ত্তত করা। বাকেরগঞ্জ জেলায় যে সেটেলমেন্ট অপারেশন চলছিল তাকে ঢালাও অপারেশনের আওতায় নিয়ে আসা হয়। ঐদিকে সিলেট জেলায় প্রথমবারের মতো যে জরিপ ও রেকর্ড তৈরির কাজ চলছিল তাকেও এস এস অপারেশনের পর্যায়ে নিয়ে আসা হলো। এই কাজটির উদ্দেশ্য শুধু ক্ষতিপূরণ তালিকা প্রস্ত্তত করা নয়, ভবিষ্যতের খাজনা ও সেস আদায়ের সুবিধার জন্য একটি নির্ভরযোগ্য ভিত্তিও তৈরি করা।

১৩ এপ্রিল ১৯৫৬ সালে ঢাকা হাইকোর্টে সরকারের বিরুদ্ধে ৮৩টি পিটিশন পেশ করা হয়। এতে বলা হয় যে সরকারের পূর্বোক্ত নোটিফিকেশন, যার বলে ১৪ এপ্রিল ১৯৫৬ তারিখ থেকে প্রদেশের সর্বপ্রকার জমিদারি ও খাজনা-আদায়ি স্বত্ব পাইকারিভাবে অধিগ্রহণ করা হয়, তা ছিল সংবিধানের পরিপন্থী। এর মধ্যে ওয়াক্ফ এস্টেটের অন্তর্গত বলে দাবিকৃত সম্পত্তি সম্পর্কে ১৪টি পিটিশন ছিল। বাকি ৪টি ছিল দেবোত্তর বলে দাবিকৃত সম্পত্তি সম্পর্কে। এই সম্পত্তিগুলি বাদে সরকার বাকি সমস্ত খাজনা-আদায়ি স্বত্ব এবং অরক্ষণযোগ্য খাসজমি উপরিউক্ত তারিখ থেকে দখল করে নেয়। ৭ আগস্ট ১৯৫৬ তারিখে হাইকোর্ট সমস্ত রিট পিটিশন ডিসমিস করে দেয়। ১৭ জুন ১৯৫৭ তারিখে এই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল ফাইল করা হয়। এইসব আপিলও ডিসমিস হয়ে যায়। তবে, যে সমস্ত কেস ছিল ওয়াক্ফ ও দেবোত্তর স্টেটের খাজনা-আদায়ি স্বত্ব সম্পর্কিত, সেগুলি মুলতবি থেকে যায়। অবশ্য সরকার এসব খাজনা-আদায়ি স্বত্বের অধীনে যে সমস্ত নিম্ন-স্বত্ব ছিল তা সমস্তই ২ এপ্রিল ১৯৫৬ তারিখের নোটিফিকেশনের বরাত দিয়ে অ্যাকোয়ার করে নেন এই বলে যে, ঐ নিম্ন-স্বত্বসমূহ ২ এপ্রিল ১৯৫৬ তারিখের আওতার অন্তর্ভুক্ত। এই সঙ্গে একটি অর্ডিন্যান্স জারি করা হলো, যার বলে ওয়াক্ফ স্টেটের মুতাওয়াল্লিদের এবং দেবোত্তর স্টেটের সেবাইতদের অনুমতি দেওয়া গেল যে তাদের স্টেটের অন্তর্গত যাবতীয় স্বত্ব (যা অ্যাকোয়ার করা স্বত্ত্বেও দখল নেওয়া হয় নি) তারা সরকারের প্রতিনিধি (এজেন্ট) হিসেবে পরিচালনা করতে থাকবেন।

এর মধ্যেই অব্যাহত রাখা হয় স্টেট অ্যাকুইজিশন অপারেশন চূড়ান্ত ক্ষতিপূরণ তালিকা তৈরির কাজ যা ১৯৬২ সালের শেষ নাগাদ সম্পন্ন হয়। অবশ্য বাকেরগঞ্জ জেলার অধিকাংশ স্থানে এবং খুলনা সুন্দরবন এলাকায় ক্ষতিপূরণ তালিকা ইতোমধ্যেই শেষ করে ফেলা হয় এবং ১৪ এপ্রিল ১৯৫৮ তারিখ থেকেই তা কার্যকরী হয়।

ঢালাও স্টেট অ্যাকুইজিশন কার্যক্রমের আওতায় সম্পাদিত ভূমি সংস্কার সরকারের আর্থিক অবস্থানের ক্ষেত্রে এক বিশেষ পরিবর্তন আনে। সরকারের ভূমি আয়ের খাতে হঠাৎ করেই রেভিনিউ ডিম্যান্ড সাড়ে নয় কোটি টাকা বেড়ে যায়, যার মধ্যে পঞ্চাশ লক্ষ টাকা ছিল খাসজমি বন্দোবস্ত দেওয়ার সময় প্রাপ্য সেলামি বাবদ। এছাড়া এই ভূমি সংস্কারের ফলে তিন লক্ষ তেতাল্লিশ হাজার একর অরক্ষণযোগ্য অতিরিক্ত খাসজমি সরকারের আওতায় অর্পিত হয়। এই অর্জনের আর্থিক মূল্য তৎকালীন বাজারদর অনুযায়ী আনুমানিক ১৫ কোটি টাকায় উপনীত হয়। ঢালাও স্টেট অ্যাকুইজিশনের পূর্বে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ভূমিরাজস্ব খাতে বার্ষিক ডিম্যান্ড ছিল ১৭৬ কোটি টাকা। তবে, সমস্ত খাজানা-আদায়ি এবং অতিরিক্ত খাসজমি অধিগ্রহণের ফলে দেয় ক্ষতিপূরণের মোট অঙ্ক দাঁড়ায় ৩,৬৩৪ কোটি টাকায়। এর মধ্যে, পাঁচবৎসর মেয়াদি এক ক্ষতিপূরণ প্রদান পরিকল্পনা অনুযায়ী সরকার কর্তৃক প্রদেয় অর্থ হয় ১,৯১৮.৬ কোটি টাকা। এতদ্ব্যতীত, নন-রেসিডেন্ট ক্ষতিপূরণ প্রাপকদের নামে নির্ধারিত ক্ষতিপূরণের টাকার অঙ্ক দাঁড়ায় ৯৯৩.২ কোটি যা ব্লকড একাউন্ট-এর মাধ্যমে প্রাপকদের ৪০ বৎসর মেয়াদি বন্ডে পরিশোধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

উপরিউক্ত ভূমি সংস্কার কার্যক্রমের ফলে পূর্ব পাকিস্তানে যে অবস্থার সৃষ্টি হয় তা সংক্ষেপে বলতে গেলে, নিম্নরূপ:

ক. ভূমিব্যবস্থার সর্বনিম্নে অবস্থিত রায়ত বা কোর্ফা প্রজা (যে নিজ হাতে জমি চাষ করে) সরাসরি সরকারের অধীনে জমির মালিক (যেখানে নিজ নামে তার জমি রেকর্ড হয়েছে) হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে; খ. জমিদারি ব্যবস্থা বিলোপের পর নবলব্ধ উন্নত স্বত্ব পেয়ে জমির সর্বনিম্ন পর্যায়ের ভূমিচাষিরা উৎপাদন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে নতুন উদ্দীপনা লাভ করে; গ. সকল খাজনা আদায়কারীর দখলে যেসব অরক্ষণীয় খাস জমি ছিল, অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে সরকারের আওতায় আসায় প্রান্তিক বা বিত্তহীন কৃষকদের অথবা অন্যান্য যোগ্য ব্যক্তিদের মধ্যে জমির সুষ্ঠু ও ন্যায়সঙ্গত বিতরণের সুযোগ বিস্তৃত হয়; ঘ. ভূমিমালিকানা স্বত্বের উপরের সীমারেখা বেঁধে দেওয়ায় ভূমিসম্পত্তির কেন্দ্রীভূতকরণ প্রক্রিয়া রহিত হয় এবং চাষিপ্রজারা সরাসরি সরকারের অধীনে চলে আসার ফলে তারা পূর্বের মতো জমিদারদের বা তাদের কর্মচারীদের অন্যায় অত্যাচার ও বেআইনি দাবি থেকে নিষ্কৃতি পায়; এবং ঙ. সর্বশেষ পর্যায়ের ভূমিস্বত্বে ইজারার নতুন স্বত্ব সৃষ্টি করা নিষিদ্ধ হওয়ায় ভূমিস্বত্বের বিভিন্ন স্তরসৃষ্টিও বিলুপ্ত হয়ে যায়।

ভূমির খন্ডিতকরণ প্রক্রিয়াকে মোকাবেলা করার জন্য সরকার ১৯৬০ সালে দিনাজপুর জেলার দুইটি থানায় পরীক্ষামূলকভাবে একটি পাইলট প্রকল্প শুরু করেন। ৭৫ বর্গ মাইলব্যাপী ১৮২টি গ্রামে ৬৬,০৪৪টি খতিয়ানভুক্ত ২,৯৭,৬৮৩টি প্লটে এই পরীক্ষামূলক সমীক্ষা চালানো হয়। ১৯৬১ সালের জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে এই সমীক্ষার কাজ শুরু হয় এবং ১৯৬১ সনের ৩০ জুন তা শেষ হয়। কিন্তু স্থানীয় জনগণ, বিশেষ করে বর্গাদাররা এর তীব্র বিরোধিতা করে। এ কারণে প্রকল্পটি সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয় এবং শেষে সরকার ভূমি একত্রীকরণ প্রকল্পটিকে আইন করে নাকচ করে দেন। এই ব্যাপারটি ১৯৬২ সনে পূর্ব পাকিস্তান ভূমি রাজস্ব প্রশাসনিক তদন্ত কমিটি পরীক্ষা করে এবং মন্তব্য করে যে পূর্ব পাকিস্তানে এ ধরনের বাধ্যতামূলক কোন ভূমি একত্রীকরণ প্রচেষ্টা রায়ত-প্রজাদের নিকট গ্রহণযোগ্য হবে না। বেশিরভাগ রায়ত-প্রজার পরিবারের দখলে অতিঅল্প পরিমাণ জমি থাকায় (যাদের ৭৫ ভাগই জনাপ্রতি ৩ একরের নিচে জমি ভোগ করছিল) এবং উত্তরাধিকার আইনপ্রসূত ভূমি বিভক্তকরণ প্রক্রিয়ার ফলে প্রতিটি প্লট অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খন্ডাংশে বিভক্ত হওয়ার কারণে ভূমি একত্রীকরণ কর্মসূচি রায়ত প্রজাদের সামান্য অনুকূলেও আসবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ ছিল।

ভূমি সংস্কার সম্বন্ধে প্রচলিত সনাতন চিন্তাধারা অনুযায়ী, ভূমিরাজস্ব পরিবর্তন ও খাস জমি রক্ষণের ক্ষেত্রে একটা সীমারেখা বেঁধে দেওয়া স্বাভাবিক ছিল। তবে কিছুটা ভিন্নধর্মী চিন্তা হলো, কী করে এই সমস্যা অতিক্রম করে জমির ফসল বৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাওয়া যায়। এ সম্বন্ধে বাংলাদেশ সরকারের প্ল্যানিং কমিশনের মাধ্যমে ১৯৮০ সালের প্রথমদিকে একটি সমীক্ষার আয়োজন করা হয়। এই সমীক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত দলটি সিদ্ধান্ত নেয় যে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে সেখানকার সরকারের গৃহীত ভূমি সংস্কার পদ্ধতির প্রশাসনিক ও আইনগত দিকগুলির সঙ্গে সরেজমিনে পরিচিত হবেন এবং সংস্কার ব্যবস্থার কার্যকরণের পথে যে সমস্ত বাধানিষেধ বা অসুবিধা অথবা সমস্যা দেখা যাবে সেগুলিকে চিহ্নিত করবেন। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, জমির বর্গাচাষিরাই হলো সত্যিকার ভূমিচাষি, কেননা এরাই বেশির ভাগ জমি চাষ করে এবং সেজন্যই সকল ভূমি সংস্কার ব্যবস্থার পত্তন করতে হবে বর্গাচাষিকে কেন্দ্র করে। আরও একটা কারণে বর্গাদারদের এই ব্যাপারে মূল লক্ষ্যবস্ত্ত করা হয়। তাদেরকে মনে করা হলো পল্লী অঞ্চলের সবচেয়ে দরিদ্র ও অবহেলিত মানুষ। তাই প্রথমেই নিশ্চিত করা হলো, যেন এই দরিদ্র বর্গাদার শ্রেণীর প্রত্যেকে সর্বপ্রকার ভূমি রেকর্ডে ঠিকমতো অন্তর্ভুক্ত হয়। সঙ্গে সঙ্গে সরকার অনুধাবন করলেন যে বর্গাদারদের বর্গাস্বত্ব ও তার মেয়াদ ভূস্বামীদের খেয়ালখুশির ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকা সঠিক নয়। তখন আইন করে নির্দেশনা দেওয়া হলো যে ভূস্বামীরা ইচ্ছামতো তাদের জমির ওপর বর্গাচাষির বর্গাস্বত্ব যখন-তখন বিলোপ করতে পারবে না। যদি করতে হয় তাহলে উপযুক্ত ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তার আদেশের মাধ্যমেই তা পারা যাবে। সরকার আরও ব্যবস্থা নিলেন যে সরকারি কর্মকর্তা প্রদত্ত বর্গা সার্টিফিকেটের ওপর ভিত্তি করে বর্গাচাষিকে ব্যাংক থেকে মৌসুমি ঋণ প্রদান করা যাবে। এই ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের একটি বিশেষ ভূমিকা থাকবে, যার আওতায় উক্ত প্রতিষ্ঠানের গ্যারান্টিবলেই বিনা কোল্যাটারালে ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়া যাবে এবং এই ঋণ মঞ্জুর করতে যেন ৩০ দিনের বেশি সময় না লাগে। আইনে আরও বিধান রাখা হলো যে, (বাজার দরে) পঞ্চাশ হাজার টাকার অনূর্ধ্ব মূল্যের জমির মালিকানার জন্য কোন খাজনা বা রাজস্ব দিতে হবে না। এর চেয়ে বেশি মূল্যের জমির জন্য মালিককে আনুপাতিক হারে রাজস্ব দিতে হবে।

আধুনিক প্রযুক্তিগত উপায়ে জমির ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য যে সমস্ত উপকরণের প্রয়োজন, যেমন উন্নত বীজ, সার, সেচ ইত্যাদি ছাড়াও উৎপাদন বাড়াতে হলে বর্গাদারদের বর্গাস্বত্বের স্থায়িত্বের প্রশ্নও এসে যায়। বর্গাস্বত্ব সম্পর্কিত উপরিউক্ত ব্যবস্থাসমূহে এই প্রশ্নের যৌক্তিকতা নিহিত। পশ্চিমবঙ্গ সরকার এ-সংক্রান্ত যে আইন প্রণয়ন করেছে উল্লিখিত সমীক্ষা টিম সেগুলি পর্যালোচনা করে বাংলাদেশ সরকারের নজরে আনে।

স্টেট অ্যাকুইজিশন আইন দ্বারা প্রথমে ভূমির সিলিং বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। আইয়ুব খানের মার্শাল ল’-এর সময় (১৯৫৮-৬৯) এই সিলিং বাড়িয়ে পরিবারপ্রতি ১০০ বিঘা থেকে ৩৭৫ বিঘায় উন্নীত করা হয়। কিন্তু পরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর, ১৯৭১ সালে, এটাকে কমিয়ে পুনরায় পরিবারপ্রতি ১০০ বিঘায় নামিয়ে আনা হয়। কিন্তু একই আইনে প্রথম ২৫ বিঘা জমির জন্য খাজনা একেবারে মাফ করে দেওয়া হয়েছিল। রক্ষণযোগ্য খাসজমির ঊর্ধ্বসীমা সম্বন্ধে ১৯৮৪ সালে একটি অর্ডিন্যান্স জারি করে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যে, যেসব পরিবারের মালিকানায় ৬০ বিঘার উপরে জমি ছিল, তারা আর জমি কিনতে বা অন্যকোন উপায়ে জমি অর্জন করতে পারবে না, এমনকি উত্তরাধিকারসূত্রেও নয়। উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্তজমি এই সীমা অতিক্রম করলেই তা সরকারকে সমর্পণ করতে হবে, এর জন্য তিনি ক্ষতিপূরণ পাবেন। তবে এ সময়ে যাদের জমি ১০০ বিঘা পর্যন্ত ছিল তারা জমির মালিকানা রাখতে পারবেন। এই অর্ডিন্যান্সের আওতার একটি বিধান ছিল যে, যে কোন পরিস্থিতিতেই বর্গাচাষিকে তার বসতভিটা থেকে উৎখাত করা চলবে না, খাজনা অনাদায়ের নালিশের জন্যও নয়। এতে বর্গাদারদের স্বার্থের অনুকূলে আরও কিছু বিধান ছিল। এতে বলা ছিল যে, বর্গাচাষিকে ৫ বৎসরের জন্য চুক্তি দেওয়া যেতে পারবে এবং এই চুক্তি অনুযায়ী যদি চাষের জন্য বর্গাদার নিজের লাঙল গরু, বীজ, সেচের পানি ও সার নিজেই যোগাড় করে তাহলে তিনি ফসলের দুই-তৃতীয়াংশ পাবেন। কিন্তু এই উপকরণগুলির (লাঙল, গরু ব্যতীত) খরচ যদি জমির মালিক বহন করেন, তাহলে তিনি ফসলের দুই-তৃতীয়াংশ পাবেন। কিন্তু এই আইনের বিধানগুলি এখনও পুরোপুরি কার্যকর করা হয় নি।

১৯৮৯ সালে বাংলাদেশে আরও দুটো আইন পাশ করা হয়। একটি ভূমি আপিল বোর্ড অ্যাক্ট এবং দ্বিতীয়টি ভূমি সংস্কার বোর্ড অ্যাক্ট। এই আইন দুটোর মাধ্যমে সমগ্র দেশের ভূমি ব্যবস্থাপনা প্রশাসনকে আরও বেশি শক্তিশালী করার চেষ্টা করা হয়। স্বাধীনতা-পূর্ব ভূমি প্রশাসনের শীর্ষে অবস্থিত ভূমি রাজস্ব বোর্ড যেভাবে কাজ করত, সেই আদর্শেই নবপ্রতিষ্ঠিত ভূমি আপিল বোর্ড এবং ভূমি সংস্কার বোর্ড স্থাপিত হয়। এখন যদিও রায়ত প্রজাদের স্বত্ব ইজারা দেওয়া বা নতুন ভূমিস্বত্ব সৃষ্টি করা নিষিদ্ধ হয়েছে, তবু বর্গাদারদের সমস্যা এখনও দূর হয় নি, কারণ বর্গাজমিতে তাদের আইনগত স্বত্ব আজও স্বীকৃত হয়নি এবং ভূস্বামী (ভূমির মালিক) ও তাদের বর্গাচাষিদের পারস্পরিক স্বার্থ ন্যায্যতার ভিত্তিতে নির্ণীত হয় নি। ইস্ট বেঙ্গল স্টেট অ্যাকুইজিশন অ্যান্ড টেন্যান্সি অ্যাক্ট, ১৯৫০-এর অন্তগর্ত যে সমস্ত আইনের বিধান রয়েছে, তাতে দেশের সর্বত্র বর্গাচাষের শস্য ভাগাভাগির সমস্যা, প্রান্তিক চাষিদের দুরবস্থা, বিকৃত আকারে জমি খন্ডিতকরণ সমস্যা, সনাতন নিয়মে প্রস্ত্তত ভূমি রেকর্ডের বিশ্বাসযোগ্যতা এবং সরকারের চরভুক্ত ও অন্যান্য খাসজমির বণ্টন ও ব্যবস্থাপনার অপ্রতিরোধ্য বিভিন্ন জটিলতা ইত্যাদির সমাধান খুঁজে পাওয়া যায় না। প্রকৃতপক্ষে ভূমি সংস্কার বিষয়ক বর্তমান ধারণা বা পরিকল্পনার সংজ্ঞাভুক্ত করে শুধু ভূমিস্বত্ব নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু এবং প্রান্তিক ও বর্গাচাষিদের সমস্যা মোকাবেলা করলেই বিষয়টির জটিলতা নিরসিত হয় না।

এই যুগে ভূমি সংস্কারের সংজ্ঞায় আরও অনেককিছু অন্তর্ভুক্ত করা আবশ্যক, যেমন সুষ্ঠু ভূমি ব্যবস্থাপনা, যার মাধ্যমে ঠিকমতো প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহের দ্বারা শস্যের উৎপাদন বাড়ানো যায়। এছাড়া খামারে উৎপাদিত শস্যসমূহের বাজারজাতকরণ ও ব্যাংক ঋণ নিশ্চিত করা এবং স্থানীয় এলাকাগত বিশেষ কোন সমস্যা থাকলে তা দূর করার ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। [তফাজ্জল হুসেন]

Comments

Popular posts from this blog

Growth vs Development- ENGLISH

  Economic growth is the increase in goods & services produced by an economy or nation, considered for a specific period of time. The rise in the country’s output of goods and services is steady and constant and may be caused by an improvement in the quality of education, improvements in technology, or in any way if there is value addition in goods and services which is produced by every sector of the economy. It can be measured as a percentage increase in real gross domestic product. Where a gross domestic product (GDP) is adjusted by inflation. GDP is the market value of final goods & services which is produced in an economy or nation. Economic Development is the process focusing on both qualitative and quantitative growth of the economy. It measures all the aspects which include people in a country become wealthier, healthier, better educated, and have greater access to good quality housing. Economic Development can create more opportunities in the sectors of education, ...

Peasant Movements: Part II, The Pabna Rebellion

Pabna Rebellion 1873: The Pabna Rebellion took place in 1873 in Serajgunj sub-division of Pabna district in East Bengal (present Bangladesh) . This rebellion resulted in the introduction of many Acts to create a new form of land ownership system. During this period in many parts of Bengal, there was a new class of cultivators who were trying to rise up to the position of being big landlords or zamindars. The existing local landlords or zamindars had a problem in this rise of the new cultivator class. The Bengal Rent Act X of 1859 provided legal rights of occupying land to the new class of cultivators. However, since the existing zamindars did not want the new class of cultivators to get any form of legal right to occupy land for cultivation, they tried to lease land (or to give out land in rent) and created many levels of tenants. Tenants refers to the small and medium peasants who take land from the local zamindars for cultivation and they have to pay a fixed rent or tax to the zami...

VILLAGE COMMUNITY : FEATURES AND TYPES

  Classification of Villages: 4 Categories I. On the Basis of Structure: Structurally villages in India can be divided into following types: 1. The Nucleated Village: This is a common pattern of settlement mostly discernible in paddy growing areas. In this type of village, homes of farmers and artisans are clustered together. ADVERTISEMENTS: Their land is located outside the village at varying distance. Their livestock are often housed along with them or nearby them. This type of villages are characterised by residential proximity, neighbourhood, community feeling etc. 2.  The Linear Village: In this type of village, houses are built on parallel rows. Each house is surrounded by small gardens. The paddy fields are at a distance from the house. This pattern of settlement unites the social advantage of residential closeness and economic advantages of living on one’s land. 3.  Dispersed Village: The village in which the dwelling places of the village lay scattered or diffuse...